প্রসঙ্গ – গ্রেট ব্যারিয়ার রিফ
লেখায় পারিজাত ব্যানার্জী
জলেরা গল্প বলে। হারিয়ে যাওয়ার, হারানোর, আবার কখনো কখনো, ফেরত পাওয়ার। তার নীল স্যাঁৎসেতে আঁচলে ভিজে জমা পরে যেই শ্যাওলা আর বালি, প্রতিদিন বিকেল নাগাদ সিগালেরা তার পাড় বরাবর জমা হয় – সেই গল্প শুনবে বলে। পাহাড়ের ছায়াপথ ধরে সূর্য যখন তোড়জোড় শুরু করে ঘরে ফেরার, অভিমানী ঢেউয়ের তখন গর্জন শোনা যায় না – শুধু সন্ধ্যার গায়ে আছড়ে পরে চলকে ওঠে দীর্ঘশ্বাস, আর শতসহস্র বছর ধরে জমতে থাকা কান্না নির্দ্বিধায় করতে থাকে অযাচিত নির্দিষ্ট বায়না। সেই কান্নার গায়ের রঙও কালো, তবে তাতে মনের মধ্যে জমতে থাকা প্রবালের রূপ এক ছটাকও কমে না! মাছেদের নিজস্ব বুদবুদ জুড়ে উড়তে থাকা গল্পগুলো লাল, নীল, হলুদ, সবুজ রামধনু মেখে দিবারাত্রি করতে থাকে তারাদের সাথে জল্পনা!
বাইরে থেকে স্থির লাগে যেই বিপুল জলরাশি বুকে বয়ে নিয়ে যাওয়া প্রশান্ত মহাসাগরকে — তার অন্দরে সৃষ্ট প্রবাল প্রাচীরের মধ্যে বাস করা অনন্য আর এক সংসার কিন্তু সেই আপেক্ষিক স্থিরতার খবর রাখে না। একে অপরের উপর সবাই সেখানে ভর করে চলে — তারা জানে, প্রাণের রূপরেখা কি, কিই বা তার মন্ত্রণা! কেউ শেখায়না এখানে কাউকে কোনোকিছু -প্রয়োজনও পড়েনা কিছুটা কোনো সামান্য পাঠশালার — অথচ সবাই জানে তাদের ঠিক কি কি করতে হবে – কিভাবে নিপুণভাবে চলতে থাকবে একে অপরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে নিত্যনৈমিত্তিক জীবনসংগ্রাম!
সে এক অন্য জগত।অনন্য, অনন্ত! ডুবসাঁতার দিয়ে তার ধার বরাবর যাওয়া যায় বটে বেশ খানিকটা কসরত করে, তবে এই স্বপ্নের গায়ে আঙুল ছোঁয়ানো চলবে না। আমাদের, মানে মানুষের লোভে যে বিষ রয়েছে, তার ঘোলাটে বাসনা থেকে এ জগতকে রাখতেই হবে আলাদা – নাহলে যে আর নিশ্চিন্তে শুয়ে স্বপ্ন দেখার কোনো মানেই কখনও থাকবে না! প্রাণী আর উদ্ভিদ একনাগারে বাস করে চলেছে যেখানে হাজার হাজার শতাব্দী জুড়ে, তার অর্ধেকও বুঝতে পারা সত্যিই আমাদের কর্মও বোধহয় নয়। নিশ্বাস বন্ধ করে জলের নিচে বেশ কিছুক্ষণ ভেসে থাকা যায় বটে সত্যিই , তবে তাতে ভর করে জলজ জগতের স্থিরতা রোমন্থন করা যাবে না।
আরো পড়ুন : পাখির ডাকের মাঝে নিরালায় দুটো দিন কাটাতে চান? প্রকৃতির ঠিকানা বিচিত্রপুর
জাহাজের ডেকে বসে রোদ পোয়ানোর সময় সমুদ্রের ভিতরকার এই কর্মকাণ্ডের কিছুই হদিশ মেলে না। নীল জলের ঘেরাটোপে রেখাচিত্র একটা ফুটে ওঠে ঠিকই এই সুদীর্ঘ দৃপ্ত সবজে চকচকে প্রাচীরের, তবে তার বিশালত্বের পরিচয় মেলে না। আমরা বলি না কথায় কথায়, “তার ভিতরটা কত গভীর” – মুখে মাস্ক পরে পায়ে নকল ডানা যোগ করে প্রাণপণে যখন প্রথমবার মাথাটা ঢুকিয়ে দিই সেই দিগন্তবিস্তৃত নীলাভ-সবুজে অনন্ত জলরাশির মধ্যে – টের পাই, প্রকৃত অর্থে ঠিক ‘গভীর’ কাকে বলে! আমার থেকে আরও অন্তত চার থেকে পাঁচহাত নীচ দিয়ে ভেসে চলেছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত ডুবুরিরা — তারও অন্তত এক থেকে দেড় হাত নীচে সেই অপ্রাকৃতিক অলৌকিক ভীষণ অন্য কর্ম যজ্ঞ – এর থেকে স্বর্গীয় আর অনির্বচনীয় আর কিছুু রয়েছে বলে এখন আর কোনোমতেই বিশ্বাস কিছুতে হয়না!
সে দেশের প্রাচীর আমাদের ইঁট কাঠ কণ্ক্রিটের মতো প্রাণহীন নয় — জীবন্ত! তাদের প্রতিটা প্রস্তরের আলাদা রূপ, বর্ণ, পরিচয়। সবই এক জৈবিক ও বৈজ্ঞানিক ধারার অন্তর্ভুক্ত ঠিকই, তবুও বড্ড ব্যতিক্রমী – স্বতন্ত্র! রঙিন পৃথিবীজ যা কিছু সম্ভব – তার সব মাত্রাকে ছাড়িয়ে এই উন্মোচন — একে কাছ থেকে চোখের দেখা দেখাও সত্যিই – অতিপ্রাকৃতিক নৈসর্গিক কোনো অন্য আলাপের মূর্চ্ছনা!
আলাদা করে স্বর্গ বলে কিছু হয় কিনা জানা নেই – সেখানে যাওয়ার মতো অত পুণ্যও জমা পড়বে কিনা নানান এই নির্নিমেষ চক্রব্যূহের জ্বালে বহু আলোকবর্ষ দূরে – জানিনা। আমার খরচের নিত্যদিনের খাতায় কি যে লেখা চলছে নিরন্তর — কেই বা তা নির্দিষ্ট করে বলতে পেরেছে কখনও? তবে একথা হলফ করে বলাই যায় বোধহয় এখন নির্দ্বিধায় — যে গল্প শুনে এসেছি প্রশান্ত মহাসাগরের মাঝবরাবর ওই ওপাড়ের অন্য দুনিয়ায়, তার রেশ ধরেই বৈতরণী পেরোনো এখন আমার আর কোনোভাবেই কখনও অসাধ্য কিছু নয় !
এই লেখকের আরো পড়ুন :